কিডনি আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি রক্ত পরিশোধন, পানি ও লবণের ভারসাম্য বজায় রাখা সহ নানা কাজ করে। কিন্তু যখন কিডনিতে সমস্যা হয়, তখন শরীরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ব্যথা অনুভব হয়। এই ব্যথা অনেক সময় অন্যান্য অঙ্গের সমস্যার সঙ্গে মিলিয়ে যায়। তাই “কিডনির ব্যথা কোথায় হয়?” – এটা জানা খুব জরুরি।
Table of Contents
কিডনির ব্যথা কোথায় অনুভব হয়?
সাধারণত কিডনি দুটি থাকে — শরীরের পেছনের দিকে, কোমরের ঠিক ওপরে। কিডনি সমস্যার কারণে ব্যথা হয় মূলত এইসব স্থানে:
- পিঠের নিচের দিকে (এক বা দুই পাশে)
- পাশে বা কোমরের ওপরে
- পেটের একপাশে
- তলপেটে
- প্রস্রাব করার সময় (যদি ইনফেকশন হয়)
নিচে কিডনি ব্যথার স্থান ও সম্ভাব্য কারণের একটি টেবিল দেওয়া হলো:
ব্যথার স্থান | সম্ভাব্য কিডনি সমস্যা | অতিরিক্ত লক্ষণ |
---|---|---|
কোমরের পাশে | কিডনি স্টোন (পাথর) | তীব্র ব্যথা, বমি |
পিঠের নিচে | কিডনি ইনফেকশন | জ্বর, ঠান্ডা লাগা |
তলপেটে | ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন | প্রস্রাবে জ্বালা |
পেটের একপাশে | পাইলোনেফ্রাইটিস | ক্লান্তি, বমি বমি ভাব |
কিডনি ব্যথার অন্যান্য সাধারণ লক্ষণ
কিডনি ব্যথার পাশাপাশি আরও কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা কিডনি সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো:
- পিঠের নিচের দিকে বা পাশে (ফ্ল্যাঙ্কে) ব্যথা
- এক পাশে বা উভয় পাশে তীব্র বা মৃদু ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- পেশাব করার সময় ব্যথা বা জ্বালা
- প্রস্রাবের সময় অস্বস্তি বা পোড়া অনুভূতি।
- প্রস্রাবে রং বা গন্ধের পরিবর্তন
- গাঢ় হলুদ, বাদামি বা লালচে রঙের প্রস্রাব
- দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব
- প্রস্রাবের পরিমাণে পরিবর্তন
- ঘন ঘন প্রস্রাব
- রাতের বেলা ঘন ঘন প্রস্রাবের তাগিদ
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- শরীরে ফোলা (এডিমা)
- মুখ, চোখের নিচে, পা, গোড়ালি বা হাতে ফোলা ভাব
- জ্বর ও ঠান্ডা লাগা
- বিশেষ করে সংক্রমণের ক্ষেত্রে হালকা বা তীব্র জ্বর
- বমি বমি ভাব বা বমি
- খাবারে অরুচি ও বমি ভাব
- অত্যাধিক ক্লান্তি বা দুর্বলতা
- সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া
- শরীরে শক্তি না থাকা
- ত্বকের খুশকি বা চুলকানি
- শরীরের ত্বকে চুলকানি বা শুষ্কভাব
- রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
- হঠাৎ উচ্চ রক্তচাপ
👉 যদি এসব লক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয় বা তীব্র হয়ে ওঠে, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
কোন লক্ষণ কোন ধরনের কিডনি সমস্যার সাথে বেশি সম্পর্কিত হতে পারে:
১️. কিডনি ইনফেকশন (পাইলোনেফ্রাইটিস)
➡️ সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- পিঠের নিচে বা পাশে তীব্র ব্যথা
- উচ্চ জ্বর ও কাঁপুনি
- প্রস্রাবে জ্বালা ও গন্ধ
- ঘন ঘন প্রস্রাবের তাগিদ
- বমি বা বমি বমি ভাব
📝 ব্যাখ্যা:
কিডনি ইনফেকশন হলে সংক্রমণের কারণে প্রদাহ হয়, যা তাপমাত্রা ও ব্যথা বাড়ায়।
২️. কিডনিতে পাথর (কিডনি স্টোন)
➡️ সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- হঠাৎ তীব্র তীর্যক ব্যথা (flank pain)
- প্রস্রাবে রক্ত (লালচে বা গোলাপি প্রস্রাব)
- প্রস্রাবে জ্বালা বা ব্যথা
- বমি বা বমি বমি ভাব
- পেশাব করতে কষ্ট হওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া
📝 ব্যাখ্যা:
পাথর যখন ইউরিনারি ট্র্যাক্টে নড়াচড়া করে, তখন ব্যথা ও ব্লক তৈরি হয়।
৩️. ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD)
➡️ সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- ধীরে ধীরে বেড়ে চলা ক্লান্তি
- শরীরে ফোলা (মুখ, হাত-পা)
- ত্বকে খুশকি বা চুলকানি
- অরুচি
- ঘুমের সমস্যা
- প্রস্রাবের পরিমাণ পরিবর্তন (কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া)
📝 ব্যাখ্যা:
কিডনি দীর্ঘদিন ধরে কম কাজ করলে শরীরে টক্সিন জমে যায়, যার ফলে এসব লক্ষণ দেখা দেয়।
৪️. অকস্মাৎ কিডনি বিকল (Acute Kidney Injury – AKI)
➡️ সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- প্রস্রাবের পরিমাণ হঠাৎ কমে যাওয়া
- শরীরে অতিরিক্ত ফোলা
- বমি বা মানসিক বিভ্রান্তি
- উচ্চ রক্তচাপ
- শ্বাসকষ্ট
📝 ব্যাখ্যা:
কিডনি হঠাৎ করে কাজ বন্ধ করে দিলে শরীরের ফ্লুইড ও ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য নষ্ট হয়।
৫️. নেফ্রোটিক সিনড্রোম
➡️ সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- শরীরে তীব্র ফোলা (বিশেষ করে চোখের নিচে, পায়ে)
- প্রস্রাবে ফেনা
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- ক্লান্তি
📝 ব্যাখ্যা:
এই অবস্থায় কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অতিরিক্ত প্রোটিন প্রস্রাবে বের হয়।
👉 সংক্ষেপে:
- তীব্র ব্যথা + রক্তযুক্ত প্রস্রাব = কিডনি স্টোন সম্ভাবনা
- জ্বর + ব্যথা + জ্বালাযুক্ত প্রস্রাব = কিডনি ইনফেকশন
- ধীরে ধীরে ক্লান্তি + ফোলা + অরুচি = ক্রনিক কিডনি রোগ
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
কিডনি সম্পর্কিত সমস্যা হলে কোন লক্ষণগুলো উপেক্ষা না করে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন, সেটা জানলে অনেক বড় জটিলতা এড়ানো যায়।
নিচে লিখে দিলাম — কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি:
⚠️ ১. তীব্র ও স্থায়ী পিঠের ব্যথা
- পিঠের নিচের দিকে, পাশে বা তলপেটে তীব্র ব্যথা হলে
- ব্যথা দীর্ঘদিন থাকলে বা বাড়তে থাকলে
⚠️ ২. প্রস্রাবে রক্ত দেখা দিলে
- প্রস্রাব লালচে, গোলাপি বা বাদামি হয়ে গেলে
⚠️ ৩. প্রস্রাবের সময় জ্বালা বা পোড়ার অনুভূতি
- প্রতিবার প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা অস্বস্তি হলে
⚠️ 4. প্রস্রাবে ফেনা বেশি হলে
- নিয়মিত প্রস্রাবে বেশি ফেনা দেখা দিলে (প্রোটিনের উপস্থিতির লক্ষণ)
⚠️ 5. মুখ, চোখের নিচে বা পা ফোলা
- হঠাৎ বা ধীরে ধীরে ফোলা শুরু হলে
⚠️ 6. অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লে বা দুর্বলতা বেড়ে গেলে
- আগে যেসব কাজ সহজে করতে পারতেন, এখন কষ্ট হলে
- সারাদিন ক্লান্তি, ঘুম ঘুম ভাব, মাথা ভার হয়ে থাকা
⚠️ 7. জ্বর ও কাঁপুনি সহ প্রস্রাবের সমস্যা
- প্রস্রাবের জ্বালার সাথে জ্বর এলে
- বিশেষ করে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর
⚠️ 8. প্রস্রাবের পরিমাণে হঠাৎ পরিবর্তন
- একেবারে কমে যাওয়া
- বা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া
- রাতের বেলা বারবার প্রস্রাবের তাগিদ
⚠️ 9. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকা
- হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে গেলে
⚠️ 10. ত্বকের চুলকানি বা র্যাশ
- দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের সমস্যা
- কোন কারণ ছাড়াই চুলকানি বাড়তে থাকলে
👉 বিশেষ সতর্কতা:
- ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের ক্ষেত্রে কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বেশি থাকে।
এই ক্ষেত্রে নিয়মিত পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া এবং সামান্য উপসর্গ হলেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব জরুরি।
প্রতিকার ও ঘরোয়া সচেতনতা
কিডনি সুস্থ রাখার জন্য প্রতিকার (চিকিৎসার পাশাপাশি) এবং ঘরোয়া সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি দু’ভাগে ভাগ করে সহজভাবে জানাচ্ছি:
✅ ১. প্রতিকার (চিকিৎসার দিক থেকে কী করবেন)
- সঠিক রোগ নির্ণয়:
কিডনি সমস্যা বুঝতে রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা (Urine R/E), কিডনি ফাংশন টেস্ট (Creatinine, eGFR), আল্ট্রাসোনোগ্রাফি খুব জরুরি। - ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন:
নিজে থেকে এন্টিবায়োটিক বা ব্যথার ওষুধ খাবেন না — এতে কিডনি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। - ডায়াবেটিস/রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা:
এগুলো নিয়ন্ত্রণে না থাকলে কিডনি ধীরে ধীরে নষ্ট হতে পারে। - প্রতিনিয়ত পর্যাপ্ত পানি পান:
তবে কিডনি রোগের পর্যায় বুঝে পানি খাওয়ার পরিমাণ চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন।
🏡 ২. ঘরোয়া সচেতনতা ও জীবনধারার টিপস
🥗 খাদ্যাভ্যাস:
- লবণ কম খান (সোডিয়াম কমাতে হবে)
- ফাস্টফুড, প্রসেসড খাবার, অতিরিক্ত তেল-চর্বি পরিহার করুন
- পর্যাপ্ত ফলমূল, শাকসবজি খান (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পটাসিয়ামের মাত্রা দেখে)
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন (অতিরিক্ত নয়)
- বেশি প্রোটিন খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন (বিশেষ করে CKD থাকলে)
🚶 জীবনযাত্রা:
- নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন (হাঁটা সবচেয়ে ভালো)
- পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ কমান
- ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন
📋 নিয়মিত পরীক্ষা করুন:
- যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতীতে কিডনি ইনফেকশন হয়েছে — প্রতি ৬ মাসে একবার কিডনি ফাংশন টেস্ট করুন।
❌ কোন অভ্যাসগুলো বাদ দেবেন:
- নিজে থেকে ব্যথার ওষুধ (NSAIDs) খাওয়া
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ফেলে রাখা
- কম পানি খাওয়া (বিশেষ করে গরমকালে)
- বেশি লবণ খাওয়া
- বেশি প্রোটিন ডায়েট গ্রহণ (ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া)
FAQ (সাধারণ প্রশ্নোত্তর)
প্রশ্ন ১: কিডনির ব্যথা কি পিঠে হয়?
হ্যাঁ, কিডনির ব্যথা সাধারণত পিঠের নিচের দিকে এবং পাশে হয়।
প্রশ্ন ২: কিডনির ব্যথা কতক্ষণ থাকে?
এটি কারণভেদে ভিন্ন হতে পারে। পাথরের কারণে ব্যথা হঠাৎ শুরু হয়ে তীব্র হয়। ইনফেকশনের কারণে ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়ে।
প্রশ্ন ৩: কিডনি ব্যথা হলে কী কী পরীক্ষা করা হয়?
ইউরিন টেস্ট
আলট্রাসনোগ্রাফি
রেনাল ফাংশন টেস্ট
সিটি স্ক্যান (প্রয়োজনে)
প্রশ্ন ৪: কিডনি ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে কী করবো?
প্রথমে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। পানির পরিমাণ বাড়ান, ঘরোয়া প্রতিকার অনুসরণ করুন, এবং ওষুধ সময়মতো খান।
উপসংহার
কিডনির ব্যথা হালকাভাবে নেওয়ার মতো নয়। সময়মতো বুঝতে পারলে অনেক বড় জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যদি আপনার কোমরের পাশে বা পিঠে ব্যথা হয় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সচেতনতা ও সঠিক অভ্যাসই পারে কিডনিকে সুস্থ রাখতে।