কিডনির পয়েন্ট কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়? জানুন বিস্তারিত

আমাদের শরীরের অতিপ্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ হলো কিডনি বা বৃক্ক। কিডনি শরীরের বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি ছেঁকে মূত্র আকারে বাইরে বের করে দেয়। কিন্তু কিডনি যদি ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন শরীরে জমতে থাকে টক্সিন ও অতিরিক্ত তরল, যা জীবনঘাতী হতে পারে। এ অবস্থায় প্রয়োজন পড়ে ডায়ালাইসিস—একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা কিডনির কাজ সাময়িকভাবে করে দেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কিডনির পয়েন্ট বা ফাংশন কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়? চলুন বিস্তারিত জেনে নিই।

Table of Contents

GFR (Glomerular Filtration Rate) কী?

GFR (Glomerular Filtration Rate) বা গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট হলো কিডনির কার্যক্ষমতা পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সহজভাবে বললে, এটি জানায় প্রতি মিনিটে কিডনি কত মিলিলিটার রক্ত ফিল্টার বা পরিষ্কার করতে পারে।

বিস্তারিতভাবে বলা যায়:

  • আমাদের কিডনিতে ছোট ছোট ফিল্টারিং ইউনিট আছে, যেগুলোকে গ্লোমেরুলাস (glomeruli) বলা হয়।
  • এই গ্লোমেরুলাসগুলো রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি ছেঁকে মূত্র তৈরি করে।
  • GFR নির্ধারণ করে এই ফিল্টারিংয়ের গতি বা দক্ষতা।

GFR-এর মান ও কিডনির অবস্থা:

GFR (ml/min/1.73m²)কিডনির অবস্থা
90 বা তার বেশিসাধারণ বা স্বাভাবিক
60-89সামান্য কম, সচেতন থাকা উচিত
30-59মাঝারি স্তরের কিডনি রোগ
15-29গুরুতর কিডনি রোগ
15-এর নিচেকিডনি বিকল (kidney failure), ডায়ালাইসিস বা ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রয়োজন হতে পারে

GFR নির্ণয়ের উপায়:

  • সাধারণত রক্ত পরীক্ষা (Serum Creatinine) ও বয়স, লিঙ্গ, জাতিগত তথ্য ব্যবহার করে GFR অনুমান (eGFR) করা হয়।

কেন গুরুত্বপূর্ণ:

✅ কিডনির স্বাস্থ্য নির্ণয়ে এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূচক।
✅ কিডনি রোগের ধাপ (stages) নির্ধারণে কাজে লাগে।
✅ চিকিৎসা পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।

কিডনির GFR ও ডায়ালাইসিস প্রয়োজনের স্তর

নীচের টেবিলে কিডনির GFR লেভেল অনুযায়ী রোগের ধাপ ও ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হলো:

GFR (ml/min/1.73m²)কিডনির রোগের ধাপপরিস্থিতিডায়ালাইসিস প্রয়োজন?
90 বা তার বেশিস্টেজ ১স্বাভাবিক বা হালকা সমস্যানা
60-89স্টেজ ২হালকা ক্ষতিনা
30-59স্টেজ ৩মাঝারি সমস্যানা, তবে পর্যবেক্ষণ দরকার
15-29স্টেজ ৪গুরুতর সমস্যাডায়ালাইসিস শিগগিরই লাগতে পারে
১৫-এর নিচেস্টেজ ৫ (ESRD)কিডনি কার্যক্ষমতা প্রায় বন্ধহ্যাঁ, অবিলম্বে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন

কখন ডায়ালাইসিস জরুরি হয়ে পড়ে?

ডায়ালাইসিস তখনই জরুরি হয়ে পড়ে যখন কিডনি তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা এতটাই হারিয়ে ফেলে যে শরীরে অতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ, পানি ও ইলেকট্রোলাইট জমে গিয়ে বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে, যখন GFR প্রায় ১৫ ml/min/1.73m² বা তার কম নেমে আসে এবং উপসর্গ দেখা দেয়, তখন ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হতে পারে।

ডায়ালাইসিস প্রয়োজনীয়তার লক্ষণসমূহ:

1️⃣ তীব্র ক্লান্তি, দুর্বলতা
2️⃣ বুক ধড়ফড় বা শ্বাসকষ্ট (ফুসফুসে পানি জমার কারণে)
3️⃣ বমি ভাব, বমি বা ক্ষুধামান্দ্য
4️⃣ পা, মুখ বা সারা শরীর ফুলে যাওয়া
5️⃣ সন্ধ্যাবেলা বা সারাদিন চুলকানি
6️⃣ মস্তিষ্কে প্রভাব (ধীরগতি, বিভ্রান্তি, অজ্ঞান হওয়া)
7️⃣ অতিরিক্ত পটাশিয়াম (Hyperkalemia), যা হৃদস্পন্দনে সমস্যা তৈরি করে
8️⃣ অ্যাসিডোসিস (রক্তের অ্যাসিড বেড়ে যাওয়া)

কখন ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেন:

  • শুধু GFR-এ নির্ভর করে নয় — উপসর্গ, রক্তের পরীক্ষার রিপোর্ট, এবং রোগীর সার্বিক অবস্থার ভিত্তিতে।
  • অনেক সময় অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি (Acute Kidney Injury) হলেও অস্থায়ীভাবে ডায়ালাইসিস দরকার পড়তে পারে।

👉 যখন কিডনি বর্জ্য ফিল্টার করতে না পারায় শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমতে থাকে এবং রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে, তখন ডায়ালাইসিস শুরু করা জরুরি।
👉 সময়মতো সিদ্ধান্ত নিলে জীবন রক্ষা করা যায় এবং জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

ডায়ালাইসিস ছাড়াও করণীয়

ডায়ালাইসিস ছাড়াও অনেক কিছু করণীয় আছে—বিশেষ করে কিডনির কার্যক্ষমতা যতটা সম্ভব দীর্ঘ সময় ধরে ধরে রাখা, উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা, এবং জীবনমান ভালো রাখা। নিচে বিস্তারিত দিচ্ছি:

১️. জীবনধারা ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ

লবণ কম খাওয়া — অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়ায় ও কিডনির উপর চাপ ফেলে।
প্রোটিন নিয়ন্ত্রিত ডায়েট — বেশি প্রোটিন কিডনির উপর বাড়তি কাজের চাপ দেয়। ডাক্তারের পরামর্শমতো নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ।
পানি খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ — ফুসফুসে পানি জমা এড়াতে।
ফসফরাস, পটাশিয়াম — এসবের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি (উচ্চ মাত্রা বিপজ্জনক)।

২️. রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা (সাধারণত ১৩০/৮০ mmHg এর নিচে)
ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে শর্করার মাত্রা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা — এটি কিডনির ক্ষয় দ্রুত কমাতে সাহায্য করে।

৩️. ওষুধ গ্রহণ

ACE inhibitors বা ARBs — কিডনি রক্ষায় সাহায্য করে (ডাক্তারের পরামর্শে)।
ডায়ুরেটিকস (diuretics) — শরীরের অতিরিক্ত পানি বের করতে।
অ্যানিমিয়া বা হাড়ের সমস্যার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ

৪️. নিয়মিত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ

✅ রক্তের ক্রিয়েটিনিন, GFR, পটাশিয়াম, ফসফরাস, হিমোগ্লোবিন পর্যবেক্ষণ।
✅ প্রস্রাবের পরিমাণ, রং, উপসর্গ লক্ষ্য করা।

৫️. ইনফেকশন প্রতিরোধ

✅ সংক্রমণ এড়াতে নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিচ্ছন্ন থাকা।
✅ প্রয়োজনে টিকা নেওয়া (যেমন হেপাটাইটিস বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা)।

৬️. মানসিক স্বাস্থ্য

✅ মানসিকভাবে সুস্থ থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেয়া যায়।


👉 সঠিক ডায়েট, ওষুধ, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ, এবং জীবনধারা পরিবর্তন কিডনি ফাংশন দীর্ঘদিন ধরে ধরে রাখতে সহায়ক।
👉 সময়মতো সতর্ক হলে অনেক ক্ষেত্রেই ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন বিলম্বিত বা এড়ানো যায়।

FAQ

কিডনির পয়েন্ট বলতে কী বোঝায়?

এখানে “পয়েন্ট” বলতে মূলত GFR বোঝানো হয়, যা কিডনির ফাংশন বোঝাতে ব্যবহৃত একটি মাপকাঠি।

GFR কত হলে কিডনি খারাপ ধরা হয়?

GFR ৬০-এর নিচে নামলে ধরে নেওয়া হয় কিডনি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

GFR ১৫-এর নিচে গেলে কি সবার ডায়ালাইসিস করতে হয়?

না, সবার হয় না। এটি নির্ভর করে উপসর্গ ও শরীরের অন্যান্য অবস্থা দেখে চিকিৎসকের সিদ্ধান্তের উপর।

ডায়ালাইসিস ছাড়া কি কিডনি ভালো রাখা যায়?

প্রাথমিক বা মাঝারি স্তরের ক্ষেত্রে হ্যাঁ, জীবনধারা পরিবর্তন ও নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে কিডনি ভালো রাখা সম্ভব।

উপসংহার

কিডনির পয়েন্ট (GFR) ১৫-এর নিচে নেমে গেলে এবং উপসর্গ দেখা দিলে ডায়ালাইসিস জরুরি হয়ে ওঠে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। কিডনি সুস্থ রাখতে নিয়মিত চেকআপ, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

Leave a Comment