৭১১ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের স্পেনে আগমনের মধ্য দিয়ে এক নতুন সাংস্কৃতিক যুগের সূচনা হয়েছিল, যার প্রভাব আজও স্পেনের স্থাপত্য, ভাষা ও রান্নায় টিকে আছে। গ্রানাদার বিখ্যাত আলহাম্বরা বা কর্ডোভার মহান মসজিদের মতো স্থাপত্য শুধু ইতিহাসের নিদর্শন নয়, বরং মুসলিম শাসনের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের এক জীবন্ত সাক্ষ্য। বর্তমানে স্পেনে প্রায় ২৫ লাখ মুসলিম বাস করেন, যদিও এটি মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। তবুও এই স্থাপত্যগুলো স্পেনের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে আছে, যাতে মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।’ এই বাণী যেন স্পেনের বিভিন্ন স্থাপত্যে চোখে পড়ে। যেমন, গ্রানাদার আলহাম্বরা—নাসরিদ রাজবংশের তৈরি এই প্রাসাদ ও দুর্গ কমপ্লেক্সের দেয়ালের লালচে আভা থেকেই এসেছে এর নামের অর্থ ‘লাল’। এখানকার খিলান, অলংকরণ আর বাগান এক অনন্য শিল্পরুচির প্রকাশ। ১৫ শতকে মুসলিম শাসনের অবসানের পরও এটির সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রয়েছে।
অন্যদিকে, কর্ডোভার মহান মসজিদ এক আশ্চর্য নিদর্শন, যা অষ্টম শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং বহুবার সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় যেন খেজুরগাছের বাগানে প্রবেশ করা হয়েছে। এর লাল-সাদা খিলান আর স্তম্ভ সারিবদ্ধভাবে সাজানো, যা ইসলামি স্থাপত্যের সরলতা ও সৌন্দর্য প্রকাশ করে। যদিও এটি পরবর্তীতে গির্জায় রূপান্তরিত হয়েছে, মূল স্থাপত্যশৈলী আজও অক্ষত।
কর্ডোভার কাছেই রয়েছে মদিনা আজ-জাহরা, উমাইয়া খিলাফতের আমির আবদুর রহমান তৃতীয় নির্মিত এক রাজকীয় এস্টেট। এটি ছিল একাধারে প্রশাসনিক ও আবাসিক নগরী। বর্তমানে এখানকার স্তম্ভ, খিলান আর দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ দেখলে বোঝা যায় মুসলিম শাসকদের স্থাপত্য রুচি কতটা উন্নত ছিল।
আরাগনের সারাগোসার আলজাফেরিয়া প্রাসাদও এক চমৎকার উদাহরণ। ১১ শতকে নির্মিত এই দুর্গের ভেতরের মার্বেল সজ্জা আর খিলানগুলো আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এটি কখনো রাজাদের বাসভবন, কখনো কারাগার, আবার এখন আরাগনের আঞ্চলিক সংসদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সেভিয়ার রিয়াল আলকাজার দুর্গটি মুসলিম স্থাপত্যের আরেক অনন্য নিদর্শন। যদিও এটি পরে খ্রিষ্টান শাসকেরা প্রায় নতুন করে নির্মাণ করেন, তবুও এর অলংকরণ ও নকশায় ইসলামি শিল্পের স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। এর মার্জিত খিলান ও মনোরম উঠান আলহাম্বরার শিল্পধারার স্মৃতি এনে দেয়।
এই সব স্থাপত্য নিদর্শন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ইসলামি সংস্কৃতি কেবল ইতিহাসের কোনো অধ্যায় নয়, বরং আধুনিক স্পেনের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্প্যানিশ ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক কালচারের গবেষক সের্গিও ইসাবেল লুদেনা বলেছেন, ইসলামি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার স্পেনের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। একই কথা বলেছেন গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হোসে রদ্রিগেজ-দোমিঙ্গোও—ইসলামি ঐতিহ্য স্পেনের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি সংজ্ঞায়িত অংশ। স্পেনের এই ইসলামি স্থাপত্যগুলোর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, সংস্কৃতি কখনো মুছে যায় না, বরং সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়ে ওঠে।