নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বরাবরই কঠোর অবস্থানে থাকা ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের গোপন অভিযান ও ধারাবাহিক সামরিক হামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। টানা ১২ দিন ধরে চলা এই সংঘর্ষে ইসরায়েল ব্যবহার করেছে শতাধিক যুদ্ধবিমান, সশস্ত্র ড্রোন, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্র। তবে সবচেয়ে আলোচিত দিক ছিল ইসরায়েলি সেনাদের সরাসরি ইরানের ভেতরে প্রবেশ করে অভিযান পরিচালনা, যা কৌশলগতভাবে এক অভূতপূর্ব ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ।
১৩ জুন ভোররাত থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ সমন্বিতভাবে এই অভিযান শুরু করে। অভিযানের প্রথম ধাপেই লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো। পরবর্তীতে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অজ্ঞাতনামা মরুভূমি অঞ্চলে ছদ্মবেশে অবস্থানরত মোসাদ সদস্যরা অস্ত্র স্থাপন করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র মোতায়েনের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দিয়ে ইসরায়েলি বিমানগুলোকে নির্বিঘ্নে লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সুযোগ করে দেওয়া।
একাধিক ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যাটারি ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্ল্যাটফর্মে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে আঘাত হানা হয়েছে স্পাইক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে। ছোট আকারের হলেও এসব মিসাইল লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধ্বংসে অত্যন্ত কার্যকর। একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে কোয়াডকপ্টার ও বিস্ফোরকবাহী ক্ষুদ্র ড্রোন, যেগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা স্থাপনায় আঘাত হানা হয়। এসব ড্রোন এতটাই দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয় যে, ইরান দেশব্যাপী অনুসন্ধান চালিয়ে সন্দেহভাজন ড্রোনবাহী পিকআপ ট্রাক শনাক্ত করতে বাধ্য হয়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, স্পাইক ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্রে ছিল ইন্টারনেট-নির্ভর স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যেগুলো দূর থেকে পরিচালিত হচ্ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, মোসাদ সরাসরি এসব অস্ত্র পরিচালনায় যুক্ত ছিল।
এই সাম্প্রতিক ঘটনার ধরন অনেকটাই মিল রয়েছে ২০২০ সালে তেহরানের কাছে ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে। সেসময়ও দূর-নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ব্যবহারে মোসাদ অভিযুক্ত হয়, যেখানে একটি ট্রাকে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর স্বয়ংক্রিয় বন্দুক এনে হামলা চালানো হয়েছিল।
এই সাম্প্রতিক হামলায় ইসরায়েল হারমেস ৯০০ ড্রোনসহ বিভিন্ন আকারের অস্ত্রোপযোগী ড্রোন ব্যবহার করে। যদিও ইরান দাবি করেছে, তারা কয়েকটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে, তবে পুরো হামলায় ঠিক কতটি ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছিল বা ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ কী—তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আরও এক চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে গোয়েন্দা তদন্তে—ইসরায়েল গত কয়েক বছর ধরেই ইরানের ভেতরে গোপনে ক্ষুদ্র ড্রোন ও বিস্ফোরক তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিল। তেহরানের উপকণ্ঠে শাহার-এ-রেই এলাকায় এমন একটি কারখানার অস্তিত্ব নিশ্চিত করা হয়, যেখানে হাতে তৈরি বিস্ফোরক, টাইমার এবং ছোট বোমাসহ ড্রোন প্রস্তুত করা হচ্ছিল। একাধিক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও প্রচার করে ইরান সরকার।
১৩ জুন সকালের আগেই তেহরানে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব হামলার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর পেছনে ছিল ইরানের ভেতরে মোসাদের গোয়েন্দা তৎপরতা। ইসরায়েল যাতে নির্বিঘ্নে হামলা চালাতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ কেন্দ্রগুলো অকার্যকর করে ফেলা হয়।
অন্যদিকে, সামরিক অভিযানের পাশাপাশি চালানো হয় সাইবার হামলা। ইসরায়েলপন্থী হ্যাকারদের একটি দল ইরানের দুটি ব্যাংক এবং একটি বড় ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জে হামলা চালায়। এতে ইরানের ইন্টারনেট অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে—দেশটির ৯৭ শতাংশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নিরাপত্তা ইস্যুতে ইরানের মহাকাশ বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার আহ্বান জানান। তবে এর কিছুদিন পরই তেহরানের একটি বাংকারে বৈঠকের সময় তিনি নিজেই এক হামলায় নিহত হন।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি জানান, তাদের কমান্ডো ইউনিট শত্রুর ভূখণ্ডে গোপনে প্রবেশ করে সফলভাবে মিশন পরিচালনা করেছে। যদিও নির্দিষ্ট করে তিনি কোন অভিযানের কথা বলেছেন, তা প্রকাশ করেননি।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের এই সমন্বিত, প্রযুক্তিনির্ভর ও বহুস্তরীয় হামলা আধুনিক যুদ্ধ কৌশলে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গোয়েন্দা তৎপরতা, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, সাইবার যুদ্ধ ও তথ্য-প্রযুক্তি—সব মিলিয়ে এই সংঘাত ইরানের জন্য কৌশলগত ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব এখন দেখছে—পরিবর্তিত যুদ্ধক্ষেত্রে সীমানা, সময় ও প্রযুক্তির ব্যবধান কতটা ভেদযোগ্য হয়ে উঠেছে।
সূত্র: Al Jazeera