জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পরও এখনো বহু বিষয়ে ঐক্যমত্যের দেখা মেলেনি। সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ সংক্রান্ত আলোচনার তিনটি ধাপ শেষ হলেও, কোনো একটি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগ নিয়েই এখনো মতবিরোধ রয়ে গেছে।
কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ রোববার এক বৈঠকে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম—আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে সবাই মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, সেটা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।” তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।
এখন পর্যন্ত ৯টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল দুটি বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন এবং বিরোধী দলকে আসন অনুযায়ী সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া। তবে ‘প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল’ নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএনপি বলেছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণের প্রস্তাবে একমত হতে পারে, যদি সংবিধানে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা এনসিসি গঠনের বিধান বাদ দেওয়া হয়।
নিয়োগ কমিটি এবং সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে মতানৈক্য এখন সবচেয়ে স্পষ্ট। নিয়োগ কমিটি নিয়ে অধিকাংশ দল ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও বিএনপিসহ কয়েকটি দল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সংসদে দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে দলগুলো একমত হলেও উচ্চকক্ষের সদস্য বাছাই পদ্ধতি নিয়ে বিভাজন প্রকট। কারও মতে, ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হওয়া উচিত, আবার কেউ বলছে—নিম্নকক্ষে যেসব দল আসন পাবে, সেই অনুপাতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মতভিন্নতা আলোচনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। কেউ বলছে, উচ্চকক্ষে যদি বাস্তব কোনো ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। আবার কেউ বলছে, নিম্নকক্ষের প্রতিরূপ হয়ে গেলে উচ্চকক্ষ অর্থহীন হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় এনসিপির নেতা আখতার হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, বিএনপি ও তাদের সমমনা কিছু দল যেভাবে আপত্তি জানাচ্ছে, তাতে বাস্তব কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এইভাবে চললে কিয়ামত পর্যন্তও ঐক্য হবে না।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, “সব বিষয়ে যদি আমাদের একমত হতে বাধ্য করা হয়, তাহলে আলোচনার দরকারটা কী?” তাঁর মতে, যেসব প্রস্তাবে সবাই একমত হতে পারে, সেগুলো নিয়েই অগ্রসর হওয়া উচিত।
আলোচনার একপর্যায়ে এনসিপির এক নেতা প্রস্তাব দেন, বিএনপির অবস্থান আগেই পরিষ্কার করে নেওয়া হোক, যাতে এক প্রস্তাব নিয়ে বারবার আলোচনা আটকে না যায়।
আলী রীয়াজ বৈঠক শেষে জানান, নিয়োগ কমিটি এবং উচ্চকক্ষ নিয়ে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে, তবে চূড়ান্ত ঐক্য পেতে সংশোধিত প্রস্তাব প্রস্তুত করা হচ্ছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে সমাধান আসবে।
সব ঠিক থাকলে জুলাই মাসের মধ্যেই “জুলাই সনদ” ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ২ জুলাই।