বাংলাদেশে কিডনি রোগের হার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না—কিডনিতে সমস্যা হওয়ার আগেই আমাদের শরীর কিছু সংকেত দেয়। এই সংকেতগুলো বুঝতে পারলে সময় থাকতে চিকিৎসা নেওয়া যায় এবং কিডনি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হওয়ার আগেই প্রতিরোধ সম্ভব হয়।
তাই আজকের এই লেখায় জানবেন, কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়, কিডনি সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ, বাসায় বসেই কিছু পরীক্ষা, কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এবং কীভাবে কিডনি ভালো রাখা যায়।
Table of Contents
কিডনির কাজ কী?
কিডনির কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক জটিল। সহজভাবে বললে, কিডনি হলো আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক ফিল্টার। মানবদেহে দুটি কিডনি থাকে, পিঠের নিচের দিকে, মেরুদণ্ডের দু’পাশে।
কিডনির প্রধান কাজগুলো:
- রক্ত পরিশোধন
→ কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ (যেমন ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন), অতিরিক্ত পানি এবং লবণ ছেঁকে বের করে দেয় — যা পরে মূত্রের (ইউরিনের) মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। - পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষা
→ শরীরে কতটুকু পানি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম বা অন্যান্য ইলেকট্রোলাইট দরকার — তা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে শরীরের রক্তচাপ ও কোষের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় থাকে। - রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
→ কিডনি হরমোন (যেমন রেনিন) নিঃসরণ করে, যা রক্তনালী সংকুচিত বা প্রসারিত করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। - লাল রক্তকণিকা তৈরি হওয়াতে সহায়তা
→ “এরিথ্রোপয়েটিন” নামক হরমোন তৈরি করে, যা অস্থিমজ্জাকে (bone marrow) লাল রক্তকণিকা তৈরিতে উদ্দীপিত করে। - অ্যাসিড-ক্ষার ভারসাম্য রক্ষা
→ রক্তের pH (অ্যাসিড/ক্ষার মাত্রা) নিয়ন্ত্রণ করে শরীরকে সঠিক ভারসাম্যে রাখতে সাহায্য করে। - ভিটামিন D সক্রিয় করা
→ খাদ্য বা সূর্যের আলো থেকে পাওয়া ভিটামিন D কে সক্রিয় (active) করে, যা হাড় শক্ত রাখার জন্য ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে।
কিডনি রক্ত পরিষ্কার রাখে, শরীরের তরল ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্ত তৈরিতে সহায়তা করে।
কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার কিছু সাধারণ উপায়
নীচের টেবিলটিতে কিডনি ভালো না থাকলে দেখা দিতে পারে এমন লক্ষণ, সম্ভাব্য কারণ ও করণীয় তুলে ধরা হলো:
লক্ষণ | সম্ভাব্য কারণ | করণীয় |
---|---|---|
প্রস্রাবে ফেনা | প্রোটিন লিক করছে | ইউরিন টেস্ট করান |
হাত-পা বা চোখের পাতা ফুলে যাওয়া | পানি জমে থাকা | চিকিৎসকের পরামর্শ নিন |
প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া | কিডনি ফিল্টার কম কাজ করছে | রক্ত পরীক্ষা করুন |
সারাক্ষণ ক্লান্ত লাগা | রক্তে টক্সিন জমা হচ্ছে | কিডনি ফাংশন টেস্ট দরকার |
মাড়ি বা মুখে দুর্গন্ধ | ইউরিয়া বেড়ে গেলে এমন হয় | ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা |
রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া | কিডনির সমস্যায় প্রেশার বেড়ে যেতে পারে | নিয়মিত চেকআপ করুন |
ঘরে বসে যেভাবে বুঝবেন কিডনি ভালো আছে কিনা
ঘরে বসে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না যে কিডনি একদম ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা— কারণ অনেক সময় কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শুরুতে বড় কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ ও ঘরোয়া পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটা ধারণা পাওয়া যায়। নিচে দিচ্ছি:
যেভাবে ঘরে বসে কিডনির অবস্থা বুঝবেন:
- মূত্রের রং ও ফ্রিকোয়েন্সি পর্যবেক্ষণ করুন
🔸 মূত্রের রং স্বচ্ছ বা হালকা হলুদ হলে সাধারণত ভালো।
🔸 ঘন, বাদামি, বা লালচে রং হলে সতর্ক হওয়া উচিত।
🔸 অতিরিক্ত বেশি বা কম মূত্রত্যাগ হলে (নিয়মিত পর্যবেক্ষণে) কিডনি সমস্যা ইঙ্গিত দিতে পারে। - মূত্রে ফেনা বা বুদবুদি
🔸 বেশি ফেনা বা দীর্ঘস্থায়ী ফেনা থাকলে প্রোটিন লিক করছে— কিডনির কার্যক্ষমতার সমস্যা হতে পারে। - পা, মুখ বা চোখের চারপাশে ফোলা
🔸 সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখের নিচে বা পা ফোলা থাকলে কিডনি ঠিকমতো তরল নিঃসরণ করছে কিনা খেয়াল করুন। - রক্তচাপ পরীক্ষা করুন
🔸 উচ্চ রক্তচাপ (যেমন ১৪০/৯০ বা তার বেশি) কিডনি রোগের অন্যতম কারণ ও ফলাফল। মাঝে মাঝে নিজের রক্তচাপ মাপলে উপকার পাবেন। - থাকছে কি অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা?
🔸 কিডনি খারাপ হলে শরীরে টক্সিন জমে ক্লান্তি বা দুর্বলতা হতে পারে। - ঘুমের সমস্যা
🔸 কিডনি ঠিকমতো টক্সিন বের না করলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। - ত্বকের শুষ্কতা ও চুলকানি
🔸 রক্তে মিনারেল ভারসাম্য ঠিক না থাকলে ত্বকে শুষ্কতা বা চুলকানি দেখা দেয়।
কিডনি ভালো আছে কি না বোঝার জন্য যেসব মেডিকেল টেস্ট প্রয়োজন
কিডনি ভালো আছে কিনা নিশ্চিতভাবে বোঝার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো নির্দিষ্ট কিছু মেডিকেল টেস্ট করা।
এখানে লিখে দিচ্ছি — কিডনির কার্যক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য কোন কোন টেস্ট সাধারণত করা হয়:
🔍 ১. রক্তের টেস্ট (Blood Test)
1️⃣ Serum Creatinine (সেরাম ক্রিয়েটিনিন)
👉 রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি হলে কিডনি দুর্বল বা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
2️⃣ Estimated Glomerular Filtration Rate (eGFR)
👉 সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। GFR দেখায় আপনার কিডনি কতটা কার্যকরভাবে রক্ত পরিশোধন করছে।
👉 সাধারণত GFR > 90 ভালো, 60-89 একটু মনিটর করতে হয়, < 60 হলে সমস্যা।
3️⃣ Blood Urea Nitrogen (BUN)
👉 রক্তে ইউরিয়া ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বেশি হলে কিডনি ঠিকভাবে বর্জ্য বের করছে না বোঝা যায়।
🔍 ২. ইউরিন টেস্ট (Urine Test)
4️⃣ Urinalysis (Routine Urine Test)
👉 ইউরিনে প্রোটিন, রক্ত, চিনি বা সেল পাওয়া গেলে কিডনি সমস্যার ইঙ্গিত।
5️⃣ Urine Albumin-to-Creatinine Ratio (ACR)
👉 ইউরিনে অ্যালবুমিন (protein) মাত্রা নির্ণয় করে।
👉 কিডনি ক্ষতি শুরু হলে ইউরিনে প্রোটিন বের হতে শুরু করে — এটা আগে থেকেই ধরা যায়।
🔍 ৩. ইমেজিং (Imaging Test)
6️⃣ Ultrasound of Kidney (কিডনির আলট্রাসনোগ্রাফি)
👉 কিডনির আকার, গঠন, কোনো বাধা বা পাথর আছে কিনা তা বোঝার জন্য।
7️⃣ CT Scan / MRI (কখনো প্রয়োজনে)
👉 জটিল কেস বা টিউমার/পাথর/স্ট্রাকচার সমস্যা বুঝতে।
🧪 ৪. অন্যান্য টেস্ট (প্রয়োজনে)
8️⃣ Serum Electrolytes (Sodium, Potassium, Calcium)
👉 কিডনি ভারসাম্য রক্ষা করে— এই মিনারেলগুলোর মাত্রা ঠিক আছে কিনা দেখা হয়।
9️⃣ Parathyroid Hormone (PTH), Vitamin D level
👉 কিডনি রোগ দীর্ঘমেয়াদি হলে এই হরমোন ও ভিটামিন D লেভেলও গড়বড় হতে পারে।
সাধারণভাবে কী করানো ভালো?
বেসিক কিডনি চেকআপ প্যাকেজ:
👉 Creatinine
👉 eGFR
👉 Urinalysis
👉 ACR
👉 Ultrasound (প্রয়োজনে)
কাদের বছরে অন্তত ১ বার কিডনি টেস্ট করানো উচিত:
✅ ১. বয়স ৪০ বছরের বেশি হলে
👉 বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে পারে।
👉 তাই ৪০ বছর বা তার বেশি বয়স হলে বছরে ১ বার কিডনি টেস্ট করানো ভালো।
✅ ২. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) থাকলে
👉 উচ্চ রক্তচাপ কিডনি ক্ষতির অন্যতম কারণ।
👉 যাদের প্রেসার ১৪০/৯০ বা তার বেশি থাকে — তাদের অবশ্যই রুটিন টেস্ট করা দরকার।
✅ ৩. ডায়াবেটিস (Diabetes) থাকলে
👉 ডায়াবেটিস থাকলে কিডনি ক্ষতির (Diabetic Nephropathy) ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
👉 তাই ডায়াবেটিক রোগীদের বছরে অন্তত ১-২ বার ACR, Creatinine, eGFR টেস্ট করাতে বলা হয়।
✅ ৪. অতীতে কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলে
👉 আগে কিডনি ইনফেকশন, পাথর, বা অল্প ক্ষতির ইতিহাস থাকলে নিয়মিত মনিটর করা জরুরি।
✅ ৫. পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলে
👉 জেনেটিক বা পারিবারিক ইতিহাস থাকলে সচেতন থাকা উচিত।
✅ ৬. বেশি Painkiller (NSAIDs) খাওয়া অভ্যাস থাকলে
👉 নিয়মিত ব্যথার ওষুধ (Brufen, Diclofenac ইত্যাদি) খাওয়া হলে কিডনির ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ে।
👉 তখন প্রতি বছর টেস্ট করা উচিত।
✅ ৭. বারবার ইউরিন ইনফেকশন (UTI) হলে
👉 বেশি UTI হলে কিডনিতে প্রভাব পড়তে পারে।
✅ ৮. Autoimmune রোগ (যেমন SLE, Lupus) থাকলে
👉 এই ধরনের রোগে কিডনি আক্রান্ত হতে পারে।
কিডনি ভালো রাখতে যা যা করবেন
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন (প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস)
- অতিরিক্ত লবণ ও প্রোটিন গ্রহণ এড়িয়ে চলুন
- উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকুন
- নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন
- অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করবেন না
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. কিডনির কোন পরীক্ষাটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য?
উত্তর: eGFR টেস্ট কিডনির কার্যক্ষমতা বোঝার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষাগুলোর একটি।
২. দিনে কতোবার প্রস্রাব করা স্বাভাবিক?
উত্তর: দিনে ৬-৮ বার প্রস্রাব করা স্বাভাবিক ধরা হয়, তবে এটি পানির পরিমাণ ও আবহাওয়ার ওপরও নির্ভর করে।
৩. কিডনি ভালো রাখতে কফি খাওয়া কি ঠিক?
উত্তর: পরিমিত পরিমাণে কফি কিডনির জন্য ক্ষতিকর নয়, তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা ভালো।
৪. কোনো লক্ষণ না থাকলেও কিডনি সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, অনেক সময় প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। তাই নিয়মিত রুটিন টেস্ট জরুরি।
উপসংহার
কিডনি নীরবে কাজ করে কিন্তু সমস্যা হলে শরীরের প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রভাব ফেলে। তাই কিডনি ভালো আছে কিনা বুঝতে হলে শরীরের ছোট ছোট সংকেতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সময়মতো সঠিক পরীক্ষা ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আনলে এই নীরব ঘাতককে প্রতিরোধ করা সম্ভব।