মোটরসাইকেল আজকের আধুনিক পৃথিবীতে শুধু গতির প্রতীক নয়, এটি প্রকৌশল দক্ষতার এক অসাধারণ উদাহরণও বটে। দুই চাকার এই বাহনের ইতিহাস অনেক পুরোনো, যা শুরু হয়েছিল সাইকেলের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়। ১৮৬০-এর দশকে বাষ্পচালিত সাইকেল তৈরির প্রচেষ্টা থেকে শুরু হয় মোটরসাইকেলের যাত্রা। ১৮৬৭ সালে মার্কিন উদ্ভাবক সিলভেস্টার হাওয়ার্ড রোপার তাঁর টুইন সিলিন্ডার স্টিম ভেলোসিপেড দিয়ে এই যাত্রাকে বাস্তব রূপ দেন। এরপর ফ্রান্সে লুই-গিলোমে পেরেঅক্স এবং পিয়েরে মিশক্স মিলে একক সিলিন্ডার স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে প্রথম সত্যিকারের মোটরসাইকেল তৈরি করেন বলে মনে করা হয়।
তবে ১৮৮৫ সালে ইতিহাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, যখন জার্মান উদ্ভাবক গটলিব ডাইমলার এবং উইলহেম মেবাখ তৈরি করেন রেইটওয়াগেন নামের গ্যাসোলিনচালিত মোটরযুক্ত দ্বিচক্রযান। যদিও এতে দুটি ছোট সহায়ক চাকা ছিল, এটিকেই আধুনিক মোটরসাইকেলের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। ডাইমলারকেই ‘মোটরসাইকেলের জনক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
১৮৯৪ সালে হিল্ডেব্র্যান্ড অ্যান্ড উলফমুলার প্রথম সিরিজ প্রোডাকশন মোটরসাইকেল বাজারে আনে, যাকে জার্মান ভাষায় ‘মোটরর্যাড’ বলা হতো। একই সময়ে যুক্তরাজ্যের এক্সেলসিয়র কোম্পানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওরিয়েন্ট-অ্যাস্টার নিজ নিজ দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। ১৯০১ সালে রয়্যাল এনফিল্ড তাদের প্রথম বাইক তৈরি করে এবং একই বছর ইন্ডিয়ান কোম্পানি রেসিং মোটরসাইকেল তৈরি করে। ১৯০৩ সালে হার্লে-ডেভিডসন তাদের প্রথম প্রোডাকশন মডেল বাজারে আনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মোটরসাইকেল সামরিক বাহিনীর জন্য অপরিহার্য যান হিসেবে ব্যবহার হয়। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের হার্লে-ডেভিডসন এবং ইন্ডিয়ান কোম্পানি বিশাল সংখ্যক মোটরসাইকেল সরবরাহ করে। যুদ্ধ শেষে মোটরসাইকেল নকশা এবং প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আসে। সাসপেনশন, ব্রেক, গিয়ারবক্সে উন্নয়ন ঘটে এবং রেসিং সংস্কৃতির বিকাশ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও মোটরসাইকেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং হার্লে-ডেভিডসন ও বিএমডব্লিউ-র মডেলগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
যুদ্ধের পরে জাপানি কোম্পানিগুলো নতুন উদ্যমে মোটরসাইকেল তৈরি শুরু করে। ১৯৫০-এর দশকে হোন্ডা ছোট আকারের নির্ভরযোগ্য বাইক তৈরি করে বিশ্ববাজারে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি ও কাওয়াসাকি পুরো দুনিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে হোন্ডা সিবি৭৫০ ফোর মডেল বাজারে এনে মোটরসাইকেল প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ডিস্ক ব্রেক, ইলেকট্রিক স্টার্ট এবং চার সিলিন্ডার ইঞ্জিনের কারণে এটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
পরবর্তী দশকগুলোতে মোটরসাইকেলের বিভিন্ন বিভাগ যেমন পারফরম্যান্স বাইক, অফ-রোড বাইক ও ট্যুরিং বাইকে বৈচিত্র্য আসে। ১৯৯০-এর দশক থেকে মোটরসাইকেলে ফুয়েল ইনজেকশন, অ্যান্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম, ট্র্যাকশন কন্ট্রোলসহ আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হতে থাকে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও ইলেকট্রিক বাইকও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। হার্লে-ডেভিডসন প্রথম ইলেকট্রিক বাইক ‘লাইভওয়ার’ বাজারে আনে। ২০০৬ সালে ডাচ কোম্পানি ইভিএ প্রোডাক্টস বিভি হল্যান্ড থেকে প্রথম ডিজেলচালিত বাণিজ্যিক মোটরসাইকেল তৈরি হয়।
বর্তমানে মোটরসাইকেল শুধু যাতায়াতের বাহন নয়, এটি একটি স্টাইল, প্রযুক্তি এবং পারফরম্যান্সের মিশেল হিসেবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।