উত্তর গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ, ইসরায়েলের অভিযোগে হামাসের অস্বীকৃতি
উত্তর গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করেছে ইসরায়েল, তাদের দাবি—ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হামাস এসব ত্রাণ চুরি করছে এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করছে। তবে এই অভিযোগকে “ভিত্তিহীন” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস এবং গাজার উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ, যারা জানিয়েছেন, ত্রাণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় হামাসের কোনও সম্পৃক্ততা নেই।
সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু মুখোশধারী ব্যক্তি, যাদের কেউ রাইফেলধারী এবং কেউ লাঠিসজ্জিত, একটি ত্রাণবাহী ট্রাকের ওপর অবস্থান করছেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, এই দৃশ্যই প্রমাণ করে হামাস গোপনে ত্রাণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। বিপরীতে গাজার স্থানীয় সূত্র ও উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলি বলছে, ট্রাকগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তারা নিজেরাই পরিচালনা করছে—এবং এগুলো কোনও সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে নয়।
ইসরায়েলি মুখপাত্র ডেভিড মেনসার জানিয়েছেন, দক্ষিণ গাজায় এখনো ত্রাণ প্রবেশ করছে, তবে উত্তর গাজার বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলেননি। এদিকে একটি মার্কিন ও ইসরায়েল-সমর্থিত আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে, তারা বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় একমাত্র অনুমোদিত ত্রাণ সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ কাটজ এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তারা সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে হামাস কোনওভাবেই ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
গাজার হাইয়ার কমিশন ফর ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছে, উপজাতীয় উদ্যোগেই ত্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা দাবি করেছে, এই প্রক্রিয়ায় কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নেই। স্থানীয় এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবীরা জানাচ্ছেন, ত্রাণ প্রধানত বাস্তুচ্যুত ও দুর্বল পরিবারগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
গাজায় চলমান সংঘাতের কারণে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস্তুহীন হয়ে পড়েছে। এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ক্ষুধার্ত জনতা প্রায়ই ত্রাণবাহী ট্রাক ও গুদামে হামলা চালাচ্ছে।
ইসরায়েল হামাসকে দায়ী করে বলছে, তারা ত্রাণ সরবরাহ নিজেদের যোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করছে এবং কিছু অংশ কালোবাজারে বিক্রি করে অস্ত্র সংগ্রহ করছে। হামাস এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে।
গাজার এক উপজাতীয় নেতা জানান, “চোর ও সশস্ত্র গোষ্ঠীদের ঠেকাতে গোত্রগুলোর সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেন সাধারণ মানুষ প্রকৃতভাবে ত্রাণ পেতে পারে।”
এই ইস্যুতে সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট এক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে অভিযোগ করেন, হামাস গাজায় প্রবেশ করা ত্রাণের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এদিকে ইসরায়েলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিষয়টি নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার ডানপন্থী জোটসঙ্গীদের চাপের মুখে পড়েছেন, যারা যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছেন এবং মানবিক সহায়তা বন্ধের দাবিতে হুমকি দিচ্ছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় প্রায় ১,২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৬,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক।
শুধু গত বুধবারেই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ১১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। বর্তমানে গাজায় আনুমানিক ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছেন এবং হামাস আরও ৩০ জন নিহতের মরদেহ তাদের হেফাজতে রেখেছে।
মানবিক ত্রাণ বিতরণ ঘিরে চলমান উত্তেজনা, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং রাজনৈতিক বিভাজন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন হলেও এখনো একটি কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত।
সূত্র: Reuters